আমি মুক্তিযোদ্ধা ও কুটু’দা
আমি শেখ আবুল খায়ের, পিতা-মরহুম শেখ আবদুল মতিন, মাতা-মরহুম খায়েরুন্নেছা, গ্রাম- খেশরা, ডাকঘর= খেশরা, থানা/উপজেলা- তালা, জেলা- সাতক্ষীরা, বিভাগ- খুলনা, বাংলাদেশ।জন্মতারিখ- ০১-১০-১৯৫৫, শিক্ষাগত যোগ্যতা- এম কম (ব্যবস্থাপনা), স্ত্রী- আফরোজা খায়ের মিনু, কন্যা- নিশীথা নওশীন নিশি, পুত্র-আসিফ খায়ের বিভোর। ৭১-এ আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী। ৭ই মাচ বঙ্গবন্ধুর ভাষন আকাশবানী কোলকাতায় প্রচার হয় পরদিন ৮ই মার্চ সকালে। অধীর আগ্রহে টানটান উত্তেজনা নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভাষণ শুনলাম। পরদিন সন্ধ্যায় গ্রামের যুবকদের নিয়ে গঠন করা হলো সংগ্রাম পরিষদ, বাঁশের লাঠি নিয়ে ট্রেনিং শুরু হলো খেশরা স্কুল মাঠে। ২৬শে মার্চ থেকে হয়ে গেলাম স্বাধীনতা সংগ্রামী। ভাবতে থাকলাম কিভাবে যুদ্ধে যাওয়া যায়। এরই মধ্যে আমাদের গ্রামে মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামীরা অনেক ঘটনা ঘটালো। আমি আমার ফুফুর বাড়ী ও আমার পিতা নানা বাড়ী পালিয়ে রইলাম, এর মধ্যে আমার দূর সম্পর্কের চাচা শাহীদ আবদুল আলিম এর সাথে যোগাযোগ করে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে দু,জনে বশিরহাট (কলকাতা) গেলাম, অনেক খোজ খবরের পর মেজর জলিল ও স.ম বাবর আলী ভাইয়ের অবস্থান যেনে আমি ও আমার আলীম চাচা কলকাতায় এক ক্যাম্পে দেখা করলাম, বাবর ভাই বললেন এখানে ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ নেই, তোমরা দেশে যাও আমরা ৫/৭ দিনের মধ্যে দেশে যাব তখন তোমরা আমাদের সাথে কাজ করো। আমরা দেশে ফিরে এলাম ঠিক তার দুই দিন পর খেশরা খেয়াঘাটে আমার ও আলীমের সাথে সাক্ষাৎ করলেন বাবর ভাই, কালাম ভাই সহ অন্যরা। শুরু হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জীবন। কিন্তু কোন অস্ত্র নেই, ট্রেনিং নেই, শুধু রাতে রাতে টাবুরে নৌকায় চলাচল ও ছোটখাটো অপারেশন। এই অবস্থায় বাবর ভাইয়ের সাথে থাকতে মন চাইলো না। চিন্তা করলাম আবার ভারত যেয়ে অস্ত্রের ট্রেনিং অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবো। যে চিন্তা সেই কাজ হলো। বাবার বাক্স থেকে ১০০ টাকার নোট চুরি করে মে মাসের মধ্যে বাল্য বন্ধু সহপাঠী এম এম ফজলুল হক, শেখ আমিনুল ইসলাম ও অন্য দু’জনকে নিয়ে রওয়ানা হলাম ভারতের উদ্দেশ্যে। সরনার্থী সেজে সন্ধ্যায় পার হলাম বর্ডার, থাকলাম একরাত পাকা রাস্তার ওপরে শুয়ে, পরদিন সকালে বশির হাট। খুজতে খুজতে গেলাম বশির হাট মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট অফিসে। ওখানে ছিলেন বাচ্চু ভাই ( টুকু ভাইয়ের ছোট ভাই ) নাম লেখালাম মুক্তিযোদ্ধায়। তারপর জানলাম সূর্যসেন পার্কের পাশে আরেকটা মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট অফিস আছে। বিকেলে গেলাম সেখানে। ওখানে গিয়ে দেখি আমাদের গ্রামের জামাই ‘কুটু দা’ ও অন্য দু/এক পরিচিত ব্যক্তি। কুটুদা বললেন তোরা এখানে এলি কি করে। আমি সকল ঘটনা বললাম। তিনি বললেন এখানে তো থাকা হবে না। তোরা এক কাজ কর বাচ্চু ভাই যে ট্রেনিং ক্যাম্প পাঠায় সেখানে থাক, পরে আমার সাথে যোগাযোগ করসি। পরদিন শেখ আমিনুল ও অন্য দুজন দেশে ফিরে এল, আমি আর ফজলুল হক গেলাম টাকী ক্যাম্পে, দু-দিন পর ভ্যাবলা ক্যাম্পে। ২/৩ দিন পর কাদা বর্ষায় তাবুতে থেকে ফজলু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। কোন উপায় না পেয়ে ভ্যাবলা ক্যাম্প থেকে ২ ঘন্টা ছুটি নিয়ে এলাম বশির হাট কুটুদার কাছে। বললাম ফজলুর অসুস্থার কথা। কুটুদা বললেন ফজলু কে নিয়ে কাল এখানে চলে আয়, পরদিন ভ্যাবলা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে ফজলু ও আমি চলে এলাম কুটুদার অফিসে। তারপর বুঝলাম এটা মুজিব বাহিনী রিক্রুমেন্ট অফিস, পরিচয় হল কামরুজ্জামান টুকু ভাই, মরহুম আ. সালাম ভাই (খুলনা) বিলু কাকা ( পাইকগাছা), ছাত্তার ভাই, মামাসহ কয়েকজনের সাথে। ২/৩ দিন পর কেন্দীয় ছাত্র নেতা শাজাহান সিরাজ সাহেব কলকাতা অফিস থেকে এলেন এই অফিসে। কাজ কাম শেষে টুকু ভাইকে বললেন আমাদের কলকাতা অফিসে রান্না খাওয়ার খুব অসুবিধা, টুকু ভাই বললেন আমাদের এ অফিসে যে রান্না করে (নাম সম্ভবত বদরুল) ওকে আপনে যান। কুটুদার নির্দেশে আমি হয়ে গেলাম রাধুনী কুক্তিফৌজ আর ফজলু ৬/৭ দিন পর চলে গেল মুজিব বাহিনী ট্রেনিংয়ে। টুকু ভাই, সালাম ভাই, ইঞ্জি মুজিবুর মামা, কুটুদার স্নেহ ভালবাসায় কাটাতে থাকলাম এই অফিসে কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার ট্রেনিং নেওয়ার বাসনা আমার মাথা থেকে এক মুহুর্তের জন্যও ম্লান হয়নি। সুযোগ খুজতে থাকলাম, এর মধ্যে পরবর্তী ব্যাচ ট্রেনিং পাঠানোর জন্য রিক্রু শুরু হয়ে গেছে। কুটুদা মৌখিক ইন্টারভিউ নিয়ে একটি রেজিস্টার খাতায় যোগ্য প্রার্থীর নাম লিখে রাখতেন। আমি সুযোগ বুঝে চুপিসারে ঐ খাতায় আমার নাম লিখে রাখলাম। এরপর কুটুদা অনেকের নাম লিখেছেন কিন্তু আমার নাম খেয়াল করেন নি। ট্রেনিংয়ে পাঠানোর দিনক্ষন আমি জানতাম তাই ওই দিন সকাল থেকে ভয়ে ভয়ে আছি কি হয় আমার কপালে। সকাল ১১টার দিকে ভারতীয় সেনা বাহিনীর দুটি গাড়ী এল। ট্রেনিংএ যাওয়ার জন্য রিক্রুট করা সকলে প্রস্তুত, কিন্তু একজন কম। কুটুদা রেজিস্টারে নাম মেলাতে শুরু করলেন, তখন আমার শরীর ঘামতে শুরু করেছে। আমার বেশ মনে আছে ১৮ নম্বর আমার নাম, কুটুদা ১৭ নম্বরনাম ডাকার সাথে সাথে আমি দৌড়ে গিয়ে কুটুদার পা জড়িয়ে ধরে বললাম আপনাকে না জানিয়ে নাজেই নাম লিখেছি। আমি ট্রেনিংয়ে যাব, যুদ্ধ করব। উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে হাসতে থাকলেন। কুটুটা আমার মাথায় হাত দিয়ে বুকে টেনে বললেন যা গুছিয়ে আয়। একবুক আশা নিয়ে দুরু দুরু বুকে সবাইকে সালাম করে উঠলাম গাড়ীতে। তারপর দমদম এয়ারপোর্ট। বিমানে ওঠার অপেক্ষায় বসে আছি সবাই, এরমধ্যে দেখি আগের ব্যাচের ট্রেনিংপ্রাপ্তরা ফিরে আসছে। হটাৎ আমার ঘাড়ে একহাত, চেয়ে দেখি সে ফজলুল হক আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ওর কান থেকে তুলা বের করে আমার কানে দিতে বললো। আমি বললাম এটা কেন ও বললো বোয়িং বিমানে বিকট শব্দ হয় তাই কানে তুলা দেওয়া ভালো। ওকে বিদায় জানিয়ে উঠলাম বিমানে, তারপর কত পথ জানা নেই, তবে একটু মনে আছে বিমান থেকে নেমে একরাত থাকার পর সেনা বাহিনীর গাড়ীতে পাহাড়ের পথ বেয়ে যাচ্ছিলাম তখন নিচের দিকে তাকিয়ে অনেকের সাথে আমার ও মাথা ঘুরে বমি হয়েছিল। পৌছলাম দেরাদুন চাকুলিয়ায় আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পে। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। কিছু ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা ও কিছু বাঙালি যুবক আমাদের অভ্যার্থনা জানালো। পরে জানলাম বাঙালীরা হলেন ইনু ভাই, আম্বিয়া ভাই, জহুর ভাই, মাহবুব ভাই। আমাদের প্রত্যেককে দেওয়া হল দুটি কম্বল ও পোশাক যা আমাদের ওজনের চেয়ে বেশি। অনেক কষ্টে নিয়ে গেলাম ব্যারাকে, কাটালাম প্রচন্ড শীতের রাত। সকালে উঠেই প্যারেড গ্রাউন্ডে গেলাম, লাইনে দাড়িয়ে গাইলাম জাতীয় সঙ্গীত- আমার সোনার বাংলা। তারপর অনেক আশার ট্রেনিং শুরু হলো। ১মাস ২দিন পর ফিরে এলাম কলকাতার কোন এক ক্যান্টনমেন্টে)। রাতে তোয়াফেল আহমেদ আমাদের সকলকে নিয়ে পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে বক্তব্য রাখলেন। পরদিন আমাদের দেশে পাঠানো হল, লাইনে দাড়িয়ে দেওয়া হল অস্ত্র, গোলা বারুদ। প্রত্যেকে দেয়া হল এস.এল আর এবং গুলি ও গ্রেনেড ভর্তি ব্যাগ। আমার অবস্থা তখন করুন, এস,এল আর-টি প্রায় আমার সমান লম্বা, তখন হাসতে হাসতে বললেন একে ছোট অস্ত্র দেওয়া যায় না। তার কথায় অন্যরাসহ আমি হাসলাম। ওই দিন গভীর রাতে বর্ডার পার হয়ে ৩ মাস পর পা রাখলাম বাংলাদেশের মাটিতে। খাল বিল ধানক্ষেত সব মাড়িয়ে পৌছালাম ‘পাতরা বুনিয়া ক্যাম্পে’ । ক্লান্তিতে শরীর অবশ হয়ে বসে আছি ভাঙ্গা বিল্ডিং এর সিড়িতে, পেছন থেকে একজন বললেন- গোসল করে যা আছে সবাই খেয়ে নাও , ঘাড় ফিরিয়ে দেখি তিনি আর কেউ না, আমার কুটুদা। মুহুত্বে মধ্যে ক্লান্তি অবসাদ দূর হয়ে গেল, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম কিন্তু ভয়ে তার মুখের দিকে তাকাতে সাহস পাইনি । একদিন পর সাতক্ষীরা অ---- আর তিন জন সহযোদ্ধার সাথে নৌকায় তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হল তালা থানার ‘বাকুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে’ বিদয়ের সময় ভেজা চোখে ধরাগলায় কটুদা বললেন- তোকে তো আমি জানি, যা যুদ্ধ করে মনের সাধ পূরণ কর। তারপর বাতুয়াডাঙ্গা থেকে কাঠি পাড়া ক্যাম্প, খেশরা ক্যাম্প, অপারেশন, যুদ্ধ স্বাধীনতা, লাল-সবুজ পতাকা, কুটুদার সাথে কয়েক বছর পথ চলা। কুটুদা যুদ্ধ জয় করে হেরে গেলে মরন ব্যাধির কাছে, ঘুমিয়ে আছ তোমার স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে, আর চিরজাগরুক আছ এই কনিষ্ঠ মুজিব বাহিনীর অন্তরে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবুল খায়ের
ভাইচ প্রেসিডেন্ট, প্রশাসন বিভাগ, কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড